‘নিখোঁজ’ কমেছে, ফিরে আসা বাড়ছে
30 August 2022২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর পুরান ঢাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বংশালের ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনকে। তাঁর স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, ‘তাকে এত দিন খুঁজে পাচ্ছি না, উল্টো পুলিশ এমন আচরণ করে যে মনে হয় আমরাই অপরাধী!’
ফারজানা বলেন, ঘটনার ২১ দিন পর বংশাল থানায় নিখোঁজ বলে জিডি করা হয়। এরপর কয়েক দফায় রাজনৈতিক মামলার আসামি হিসেবে পারভেজকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ বাসায় আসে। একবার পুলিশ এসে ঘরের মালপত্র সব নিয়ে যেতে চায়।
২০১৬ সালে পারভেজের বাবা শফিউদ্দিন মারা যান। পরিবারের বড় ছেলে পারভেজ। দুই শিশুসন্তান নিয়ে পারভেজের স্ত্রী এখন তাঁর বাবার বাসায় থাকেন। অনেক দিন পর গত সপ্তাহে বংশাল থানা থেকে পুলিশ তাঁকে ফোন করে পারভেজের তথ্য জানতে চায়। পারভেজের সঙ্গে নিখোঁজ হয়েছিল আরো তিনজন। সবার পরিবারেই নতুন করে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান পারভেজের স্ত্রী।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘একটি ঘটনায় জিডি বা মামলা হলে কেস সলভ না হওয়া পর্যন্ত বারবার খোঁজ নেওয়া হতে পারে। তবে আগের যেসব ঘটনার কথা বলছেন, সেগুলো বিভিন্ন ধরনের—এদের কেউ কেউ পলাতক বা বিদেশে আছে। শনাক্ত হয়নি এমন মৃতদেহ কিন্তু আমরা পাই। এখনো এমন চার-পাঁচটি কেস আছে। নতুন করে কোনো তদন্ত হচ্ছে কি না, সেটা খোঁজ নিয়ে দেখছি। ’
এভাবেই বছরের পর বছর নিখোঁজ থাকা অনেকের অবস্থা জানা যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও আলোচনার মধ্যে গত তিন বছরে নতুন করে গুমের অভিযোগ কমেছে। নিখোঁজের পর ফিরে আসার ঘটনাও বাড়ছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩০ জুলাই পর্যন্ত ২৮ জনকে অপহরণ বা গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পাঁচজন ফিরে এসেছে। ১২ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ১১ জন এখনো নিখোঁজ।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ৩০ আগস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। গত বছর বাংলাদেশের ৮৬টি ‘গুমের’ তথ্য তুলে ধরেছিল নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। পরবর্তী সময়ে সাবেক ও বর্তমান র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের গুম বিষয়ে আলোচনা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে আসকের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, গুমের ঘটনার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে তদন্তের পাশাপাশি ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। পুনর্বাসনও প্রয়োজন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। পরিবারগুলোর আইনগত ও নৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, অবিলম্বে গুম হওয়া সব মানুষকে খুঁজে বের করা, দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে গুমের ঘটনাগুলোর তদন্ত করা, জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিখোঁজ ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
গণমাধ্যম ও সংগঠনের তথ্যের বরাত দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, ১৫ বছরে গুম ও অপহরণের শিকার ৬১৪ জনের মধ্যে পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৬৭ জনকে। লাশ উদ্ধার হয় ৭৮ জনের, ফিরে এসেছে ৫৭ জন, পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে ২২ জনকে এবং ৩৯০ জনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এক বিবৃতিতে জানায়, ‘কোথায় আছেন তাঁরা’ নামে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে ৭১টি গুমের ঘটনার বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি গুম হয়েছেন রাজনীতিবিদ, যা ১৫.৪৯ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আট শিক্ষার্থী, যার হার ১১.২৬ শতাংশ।
গুমের শিকার পরিবারগুলো কয়েক বছর ধরে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে কর্মসূচিতে মিলিত হচ্ছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে ৮৬ জন নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের তালিকা আছে।
News Courtesy: