‘ডিজিটালের মতোই সাইবার নিরাপত্তা আইন হবে নিপীড়নের হাতিয়ার’
19 August 2023সমালোচনা এড়াতে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) নাম পরিবর্তন করেছে। কিন্তু আইনের পরিকাঠামো একই রাখা হয়েছে। ডিএসএর কর্মকর্তাদের বিশেষ ক্ষমতা প্রদান, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং অনুভূতি রক্ষা ও মানহানি সংক্রান্ত বিতর্কিত ধারাগুলো প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে (সিএসএ) অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। ফলে ভিন্নমত দমনে ও নাগরিকদের নিপীড়নে ডিএসএ যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও একইভাবে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে। মৌলিক অধিকার খর্ব করবে। দিন শেষে এটি ডিএসএর মতো আরেকটি নিপীড়নমূলক আইন হবে। ডিএসএস, সিএসএ এর মতো আইন থাকলে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা করা অসম্ভব।
শনিবার ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা, উন্নত গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারটির আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
ওয়েবিনারে মুখ্য আলোচক সাংবাদিক কামাল আহমেদ ‘ডিজিটাল নিরাপত্তায় উন্নত গণতন্ত্র ও আমরা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্যসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা বা সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে আইন প্রণয়ন ও এর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। এতে বলা হয়, উন্নত গণতন্ত্রের দেশগুলোতে নাগরিকদের অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়। এ বাইরেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা ও মননের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের বিষয়ে আলাদা আইন আছে। কারও মানহানি বা রাজনৈতিক আদর্শ বা বিশ্বাসকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা পাশ্চাত্যের আইনে নেই।
প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের আইনের বিপজ্জনক বিধান হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি ও পুলিশকে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার অপব্যবহার ইতিমধ্যে দেখা গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলা বা অদক্ষতার কারণে নাগরিকদের গোপনীয়তা ফাঁস হলেও সেই প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা আইনে নেই। ইউরোপ বা যুক্তরাজ্যের আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল শুধু আইনের নামকরণের সংক্ষিপ্ত রূপ ডিএসএতেই সীমিত, নাগরিকদের অগ্রাধিকারে নয়।
কামাল আহমেদ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সরকারকে সুরক্ষা দিয়েছে। ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদদের সুরক্ষা দিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক কারণেই ভিন্নমত ঠেকাতে এ আইন ব্যবহৃত হয়েছে। এ আইনের যে ধারাগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করেছে, সেগুলো সংশোধন করতে হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। সেই ধারাগুলো প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও দেখা যাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিচারিক দায়িত্ব অনেকটা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, প্রস্তাবিত আইনেও সেটির বদল হচ্ছে না। এর মানে আপনার বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে পুলিশ কর্মকর্তার যদি মনে করে আপনি অপরাধ করবেন তাহলেও আপনাকে আটক করে নিয়ে যাবে। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইন আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। কারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইন পরিবর্তন করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে আলী রীয়াজ বলেন, সরকার প্রস্তাবিত আইনটি ওয়েবসাইটে দিয়ে বলছে, ১৫ দিনের মধ্যে যা বলার বলেন, এরপর আইন করে ফেলব। আইন করায় অংশীজনদের কোনো ভূমিকা নেই।
নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর নাম বদলে নতুন আইন করাকে ‘প্রতারণামূলক’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে কুখ্যাতি অর্জন করায় সরকার এটির নাম বদল করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঘটনা উদাহরণ তুলে ধরে নূরুল কবীর বলেন, ‘নাগরিক নয়, সরকারের নিরাপত্তা দিতেই বানানো হয়েছে এই আইন। দেশে ডিএসএস, সিএসএ এর মতো আইন থাকলে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা করা সম্ভব নয়।’
আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হয়েছে। এই আইনের যত অপব্যবহার হয়েছে, তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যারা এই অপব্যবহারের জন্য দায়ী ছিল, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর যতোগুলো দেশে ঘৃণ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রয়েছে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, নইলে জাতিসংঘ বারবার এটা নিয়ে এভাবে কথা বলতো না।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক আসিফ বিন আলী বলেন, আইনে সরকারের সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। অপরাধের সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। পুলিশকে অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী রোজিনা বেগম বলেন, আইনে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই অপরাধী গণ্য করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হতে দেখা গেছে।
ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে যে প্রক্রিয়ায় আইন প্রণয়ন করা হয়, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এ আইনে নাগরিকেরা অবহেলিত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই ভিন্নমত দমনে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন। তিনি বলেন, নতুন সাইবার সিকিউরিটি আইনে অজামিনযোগ্য ধারা পরিবর্তিত করে জামিনযোগ্য ধারা করা হলেও নাগরিকদের এই সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। অতীতে লেখক মুশতাক বহুবার জামিনের আবেদন করলেও, তাকে আটক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।
News Courtesy: