নিপীড়নমূলক হবে সাইবার নিরাপত্তা আইন: ওয়েবিনারে বক্তারা
20 August 2023সরকার ভিন্নমত দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) প্রণয়ন ও ব্যবহার করেছে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে অপরাধের সংজ্ঞা ও ধারাগুলো অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনটি জনগণকে নিরাপত্তা দেয়ার বদলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করবে। এটি ডিএসএর মতো আরেকটি নিপীড়নমূলক আইন হবে।
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা, উন্নত গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আলোচকরা গতকাল শনিবার এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারটির আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। ওয়েবিনারে মুখ্য আলোচক ছিলেন কলামিস্ট ও সাংবাদিক কামাল আহমেদ। তিনি ‘ডিজিটাল নিরাপত্তায় উন্নত গণতন্ত্র ও আমরা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হওয়ায় সমালোচনার মুখে এখন তাতে নামমাত্র পরিবর্তন করে করা হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে অপরাধগুলোর সংজ্ঞা অপরিবর্তিত আছে এবং অধিকাংশ ধারাতে সাজাও এক। ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানকে আইনটি প্রয়োগ ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, মূলত সেটির নাম বদলে সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি করা হয়েছে। কামাল আহমেদ তার প্রবন্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্যসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা বা সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে আইন প্রণয়ন ও এর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেন। তার উপস্থাপন করা প্রবন্ধে বলা হয়, ওই সব দেশে মানবাধিকারকে সাইবার নিরাপত্তার কেন্দ্রে স্থান দেয়া হয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা ও মননের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের বিষয়ে আলাদা আইন আছে, যা সাইবার নিরাপত্তা আইনের অংশ নয়। মানহানি বা রাজনৈতিক আদর্শ বা বিশ্বাসকে সুরক্ষা দেয়ার কোনো চেষ্টা পাশ্চাত্যের আইনে নেই বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের আইনের বিপজ্জনক বিধান হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি ও পুলিশকে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যার অপব্যবহার এরই মধ্যে দেখা গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলা বা অদক্ষতার কারণে নাগরিকদের গোপনীয়তা ফাঁস হলেও সেই প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা আইনে নেই। ইউরোপ বা যুক্তরাজ্যের আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল শুধু আইনের নামকরণের সংক্ষিপ্ত রূপ ডিএসএতেই সীমিত, নাগরিকদের অগ্রাধিকারে নয়। কামাল আহমেদ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সরকারকে সুরক্ষা দিয়েছে। ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদদের সুরক্ষা দিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক কারণেই ভিন্নমত ঠেকাতে এ আইন ব্যবহƒত হয়েছে। এ আইনের যে ধারাগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণœ করেছে, সেগুলো সংশোধন করতে হবে। আইনে অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করতে হবে।
আলোচনায় অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে চরমভাবে ক্ষুন্ন করেছে। সেই ধারাগুলো প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও দেখা যাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিচারিক দায়িত্ব অনেকটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল, প্রস্তাবিত আইনেও সেটির বদল হচ্ছে না। সাইবার নিরাপত্তা আইনটি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের প্রক্রিয়ারও সমালোচনা করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, সরকার প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনটি ওয়েবসাইটে দিয়ে বলছে, ১৫ দিনের মধ্যে যা বলার বলেন, এরপর আইন করে ফেলব। আইন করায় অংশীজনদের কোনো ভূমিকা নেই।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন আইন করাকে ‘প্রতারণামূলক’ বলে মন্তব্য করেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবির। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে কুখ্যাতি অর্জন করায় সরকার এটির নাম বদল করছে। এই নামবদল জনগণ ও গণতন্ত্রপরায়ণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রতারণা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরে নূরুল কবির বলেন, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের ডিজিটাল ব্যবস্থার নিরাপত্তা দিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি প্রণীত হয়নি। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে অপরাধের যে সংজ্ঞায়ন, তা অগণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের সুদূরপ্রসারী বাজে প্রভাব থাকবে। আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হয়েছে। এই আইনের যত অপব্যবহার হয়েছে, তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যারা এই অপব্যবহারের জন্য দায়ী ছিল, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের মধ্যে বড় কোনো পরিবর্তন নেই বলে উল্লেখ করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক আসিফ বিন আলী। তিনি বলেন, আইনে সরকারের সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। অপরাধের সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। পুলিশকে অবারিত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি পাশাপাশি রেখে পড়লে দ্বিধায় পড়তে হয় বলে মন্তব্য করেন গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী রোজিনা বেগম। তিনি বলেন, দুই আইনের ধারাগুলো প্রায় একই। আইনে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই অপরাধী গণ্য করে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এই সুযোগ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হতে দেখা গেছে। ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে যে প্রক্রিয়ায় আইন প্রণয়ন করা হয়, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এ আইনে নাগরিকরা অবহেলিত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই ভিন্নমত দমনে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
News Courtesy: