বাকস্বাধীনতাবিরোধী সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা প্রয়োজন

28 February 2024
No image

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘ডিজিটাল থেকে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট : কী ভাবছেন রাজনীতিকরা?’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হলেও মামলার হার কমেনি, পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এ ধরনের বাক স্বাধীনতাবিরোধী ও নিবর্তনমূলক কালো আইন বাতিল করা প্রয়োজন।

গতকাল এ ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। সিজিএস চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ওয়েবিনারে আলোচনা করেন, আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা গোলাম মাওলা রনি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিজিএস’র নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

ওয়েবিনারের শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হলেও মামলার হার কমেনি, পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। স্বয়ং বিচারক যেখানে বলেছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, সেক্ষেত্রে এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ থাকে না। তিনি বলেন, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ২০২০ সাল থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনের মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। এই আইনের অধীনে সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা। একইভাবে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে ১৮টি মামলা হয়েছে, যেখানে ১০ জন সাংবাদিক ও আটজন রাজনীতিবিদ অভিযুক্ত হয়েছেন। জিল্লুর রহমান বলেন, ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে ডিজিটাল এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন উভয়কেই ব্যবহার করা হয়েছে, আগামীতেও হবে। আমরা এও দেখি, মৃত মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে এ ধরনের কালো আইনের অধীনে। মামলার তদন্তে, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার জন্য এই আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকৃতপক্ষে মুক্তি মিলছে না।

নজরুল ইসলাম বাবু এমপি বলেন, আইন কল্যাণের জন্য, রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে, জনগণকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য প্রণয়ন করা হয়। জনস্বার্থে আইন পরিবর্তিত করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিস্বার্থে আইন তৈরি হয়নি। ডিজিটাল যুগে এ ধরনের আইনের প্রয়োজন, অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য, শনাক্ত করার জন্য। জনগণের কথা চিন্তা করেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংশোধন করে, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সরকার শতভাগ নিরাপত্তা দেয়ার জন্যই এই আইন প্রণয়ন করেছে, রাজনীতিবিদ বা সাংবাদিকদের শাস্তি দেয়ার জন্য নয়। রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে বেআইনিভাবে প্রবেশ করলে তাকে তো শাস্তি পেতেই হবে। আইন সবসময়ই প্রয়োজন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, জাতির প্রয়োজনে। এ ধরনের আইন জননিরাপত্তার জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে।

গোলাম মাওলা রনি নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, এই আইনের একজন ভুক্তভোগী হিসেবে মনে করি আইনটি অপ্রয়োজনীয় একটি আইন। এই আইন প্রণয়নের কোনো ভিত্তি নেই। এ ধরনের আইন বাতিল করা প্রয়োজন এবং এই বিষয়ে দ্বিমত নেই। আইনমন্ত্রী যতই দাবি করুন, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহার হবে না, কিন্তু আইন প্রণয়নের যে সৎ উদ্দেশ্য তা এই ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। আন্তর্জাতিক চাপে আইন সংশোধন করলেই, সেই আইন জনবান্ধব হবে তা নয়। সম্মিলিত জাতি গঠনের অন্তরায়, বাক-স্বাধীনতার উপর খড়গ এই কালো আইন এবং এই আইন বাতিল করা প্রয়োজন।

রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে হয়রানি নিয়ে আমরা আগে থেকেই জানি। এমন একটি আইন তৈরি করা হলো, যার ভিত্তি হলো ভয়। এমন ধারা-উপধারা তৈরি করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্যই ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করা। সাইবার সিকিউরিটিতে শাস্তি কমিয়ে আনা হলেও, ভীতির সেই পরিবেশ বহাল রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা পেয়েছি সেই কণ্ঠের স্বাধীনতা রদ করা হয়েছে, এই আইনের মাধ্যমে ভয় সৃষ্টি করে। জন-সম্পৃক্ততার কথা চিন্তা করে, জনস্বার্থে আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন, কন্ঠরোধের জন্য নয়।

জোনায়েদ সাকি বলেন, আইন যদি পুলিশের হাতে চলে যায় তখন সেটার ব্যবহারই অপব্যবহার। স্বাধীনতার মানে অন্যের স্বাধীনতাকে খর্ব করে আইন প্রণয়ন নয়। যে দেশে সরকার প্রধানের সমালোচনা করা যায় না, সে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে আইন প্রণয়নে স্বচ্ছতা নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে, ভয়কে জিইয়ে রাখার জন্য এ ধরনের আইন বার বার ব্যবহার করা হয়েছে, হচ্ছে।

নুরুল হক নুর বলেন, সব মহল থেকে চাপের পর জামিন অযোগ্য ধারাগুলোকে জামিনযোগ্য করে, কিছু ধারাতে শাস্তি কমিয়ে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে। এই পরিবর্তিত আইনও সাংবাদিক, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সম্ভব। ২৯ ধারায় মানহানির কথা বলা হয়েছে কিন্তু মানহানির সঠিক সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। কি অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, মানহানি হচ্ছে, তার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় অপব্যবহার করা হচ্ছে। একই অভিযোগে একজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় মামলা হয়েছে। আইনমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাত হাজার মামলার মাধ্যে পাঁচ হাজার মামলা বিচারাধীন, অর্থাৎ ৭০% মামলাই ঝুলে আছে। সাইবার স্পেসকে নিরাপত্তা দেবার জন্য এই আইনটি করা হয়নি, হয়েছে রাজনীতিবিদ, বিরোধী মতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে ফেসবুকে সরকার বিরোধী মত প্রকাশের জন্য, কিন্তু অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করার কথা।

সভাপতির বক্তব্যে ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, সংবিধানের ধারায় বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা থাকলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন তা বিরোধী। সব আইনই জনস্বার্থে তৈরি হয়নি। পুলিশ অফিসারের হাতে সব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনেও। সাইবার জগতে লাইক বা কমেন্ট করলেই মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। স্বাধীনভাবে কথা বলা বা লেখার পরিবেশ না রেখে বরং ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে। এই ধরনের নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করা প্রয়োজন।

News Courtesy:

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/817353/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B2-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%9C%E0%A6%A8

Comments