জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ জনগণের বন্ধু ছিল না

সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ-সিজিএস’র অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ : আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক আলোচনায় দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বাংলাদেশের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের বাস্তব পরিবর্তন ও সংস্কার সম্ভব হবে। তাদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া পুলিশ সংস্কার কার্যকর হবে না। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় কর্মীর ভূমিকার জন্য পুলিশ ভুল স্বীকার করেছে। গত ১৬ বছরে পুলিশের বিভিন্ন ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হলেই সংস্কার কার্যক্রম অনেকটা এগিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে পুলিশ যাতে এমন অপরাধ না করতে পারে এজন্যই পুলিশ বাহিনী ও আইনের সংস্কার করতে হবে। জুলাইয়ে পুলিশ জনগণের বন্ধু ছিল না। তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। স্বাধীন কমিশন তৈরি করা যেতে পারে।

গতকাল শনিবার সকালে সিরডাপ মিলনায়তনে (সেন্টার অফ ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আলোচনায় বক্তাদের মধ্যে ছিলেন; নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, সাবেক আইজিপি এম এনামুল হক, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, সিজিএস-এর চেয়ারপার্সন মুনিরা খান, সিজিএস- এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান, সাবেক জজ ও আইনি পরামর্শদাতা ইকতেদার আহমেদ, অধিকারের পরিচালক এএসএম নাসিরুদ্দিন এলান, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম, এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যরিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক সোহরাব হাসান, সমকাল সম্পাদক ও ব্যবসায়ী নেতা এ.কে আজাদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস) গবেষণা ফেলো সাফকাত মুনির, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ড. মাহবুবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের লেকচারার সাইমি ওয়াদুদ, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য গবেষক ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি মো: জারিফ রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী প্রতিনিধি কাজী রাকিব হোসেন ও রেজওয়ানা রশীদ প্রমুখ। 

সংলাপের শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল সুশাসনের অভাব। সংস্কার শব্দটি অনেক ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এটি ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। সংস্কার চলনীয় একটি প্রক্রিয়া। আমরা সাধারণ মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। সাধারণ জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছে না, পুলিশ মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রতিনিয়ত মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, সার্বিকভাবে কিভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ঠিক করা যায় তার উপর নজর দিতে হবে। কেবল পুলিশের উপর নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে কমিশনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কথা বলে কমিশনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যা করা হচ্ছে না। পুলিশকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। পুলিশের মানসিক স্বাস্থ্যে ঘাটতি আছে। বর্তমান প্রযুক্তিগুলো পুলিশকে শিখাতে হবে। জনগণেরও পুলিশকে সাহায্য করতে হবে। পুলিশের কাজের তদারকি করার ব্যবস্থা করতে হবে। পার্লামেন্টে পুলিশের কোড অফ কন্ডাক্ট তৈরি করতে হবে। পর্যালোচনা প্রক্রিয়া আনতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল তৈরি করতে হবে। অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলোকে সাহায্য করতে হবে যেন ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ করতে পারে। জনগণকে তাদের দাবি তুলে ধরতে হবে যেন সেই দাবিগুলো তারা পূরণ করতে পারে। 

জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, বিগত সরকার এমন আভাষ দিয়েছে যে, তারা ক্ষমতায় না থাকলে অনেক মানুষ মারা যাবে। পুলিশের সেবায় নাকি পুলিশের নিয়ন্ত্রণ দরকার! এখানে কাজ করতে হবে। পুলিশের উপর নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে যেন ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ না হয়। পুলিশের কাজ সেবা করা, এটি সব রাজনৈতিক দলকে বুঝতে হবে। 

এম এনামুল হক বলেন, রাজনৈতিক নেতার আদেশের বিরুদ্ধে না বলার সাহস থাকতে হবে সবার, যদি তা আপনার বিবেকে বেঁধে থাকে। প্রয়োজন বোধে সাহস করতে হবে। কমিশন আগেও হয়েছে কিন্তু তার প্রয়োগ হয়নি। তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, স্কুলে পুলিশের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্তিকরণে কিছু সমস্যা আছে। সাংস্কৃতিক আত্মস্থকরণ দরকার। এটি করতে সময় লাগবে। ভোট দেওয়ার অধিকার সবচেয়ে উপরে থাকবে। পুলিশকে আমরা হেনস্তাকারী সংস্থা হিসেবে তৈরি করেছি। পুলিশের পদোন্নতি উপর দিকে দেওয়া হয়েছে। ট্রাইবালিজম থেকে বের হতে হবে। বিচার সব জায়গায় থাকতে হবে কেবল পুলিশের ক্ষেত্রেই নয়। ক্ষমা সবার চেতে হবে। যারা নির্দেশ দিয়েছে ও অর্থনীতি ধ্বংস করেছে তাদেরকেও ক্ষমা চাইতে হবে ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ইতিবাচক কর্তৃত্বভীতি থাকতে হবে। অতিরিক্ত জোর প্রয়োগ যেন কেউ আর না করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। 

মো: জারিফ রহমান বলেন, পুলিশ ও জনগণের মাঝে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে জুলাই-আগস্ট গণঅভভুথানে। পুলিশ তার ভুল স্বীকার করেছে। কিন্তু দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ হয়েছে। এটার বিকেন্দ্রিকরণ করতে হবে কমিউনিটি পর্যায় থেকে। এখানে নজর দিতে হবে। চেক এন্ড ব্যালেন্স কমিউনিটি পর্যায় থেকে শুরু করলে অন্য কেউ জুলাই-আগস্টের মত কিছু করতে চেলেও তা পারবে না। কমিশনে এমন মানুষ থাকতে হবে যারা চাপিয়ে দেয়া নির্দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে।

রেজওয়ানা রশীদ বলেন, পুনর্গঠন রাতারাতি পরিবর্তন হবে এমন চিন্তা থেকে বের হতে হবে। এটার জন্য গোড়া থেকে কাজ করতে হবে। কমিউনিটি পর্যায় থেকে কাজ শুরু করতে হলে পুলিশ এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে স্কুল পাঠ্যক্রমে। মহিলা ও আদিবাসীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

কাজী রাকিব হোসেন বলেন, জুলাইয়ে পুলিশ জনগণের বন্ধু ছিল না। তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। স্বাধীন কমিশন তৈরি করা যেতে পারে। কমিশনের ভিতর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। আস্থা পুলিশের অপর থাকবে কিনা তা জনগণ নির্ধারণ করবে। পুলিশের অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। একজন একটি কাজ সামাল দিবে। বর্তমানে যেসব পুলিশের আইন আছে তার প্রতি অনুগত থাকতে হবে। র‌্যাবের দরকার নেই বাংলাদেশে। র‌্যাবকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

নুরুল হক নুর বলেন, পুলিশকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এটি প্রতিরোধ করার জন্য মানবাধিকার সনদ মানতে হবে এবং আমাদের যা নিয়ম আছে তা অনুসরণ করতে হবে। পুলিশের কাঠামো ঠিক করতে হবে। রাজনীতির সংস্কার করতে হবে। বেসরকারি সংস্থাগুলো এখানে কাজ করতে পারে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে পচন ধরেছে তার সংস্কার করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও বিকাশের মনোভাব আনতে হবে। 

ইকতেদার আহমেদ বলেন, পুলিশের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। অতীতে এবং বর্তমান সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে কাজ করছে। এরকম হতে থাকলে দেশে কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারবে না। আইন কমিশনে আসবে পিএইচডি করা ব্যক্তি। বিগত সরকার তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য কিছু বিচারককে নিয়োগ করেছিল। 

আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আমাদের দেশে একজন ভাল রাজনীতিবিদ দরকার। ভাল মানুষদেরকে সংসদে আসতে হবে, দেশ শাসনে আসতে হবে। খারাপ ভোটার খারাপ মানুষদেরকে ক্ষমতায় আনবে।

News Courtesy:

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ জনগণের বন্ধু ছিল না

Comments