রাজনীতিতে নারীর ছাঁটাই: সহিংসতা, বিদ্বেষই মূল কারণ

দীপাঞ্জালী রায় | 27 April 2025
No image

নারীর অবদান সমাজে সর্বদাই প্রশংসিত হলেও, স্বীকৃত হয়নি। তবে এই বাহ্যিক প্রশংসা এবং নারীর জন্য বাস্তব সুযোগ সৃষ্টি—এই দুটি বিষয় প্রায়শই একে অপরের সঙ্গে মেলেনা। ফলে, রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীর সক্রিয় উপস্থিতি খুবই সীমিত, এমনকি যারা অংশগ্রহণ করতে চান, তারাও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। অথচ রাজনীতি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে নারীর অংশগ্রহণ সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, সেখানে নারীদের সরব উপস্থিতি দেখা গিয়েছিলো। এই আন্দোলন শুরু হয় সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে, যা মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সন্তানদের জন্য বরাদ্দ ছিল এবং মেধার ভিত্তিতে চাকরির নিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছিল। শুরুতে ছাত্রদের মাধ্যমে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লেও, নারীরা দ্রুত এর সঙ্গে যুক্ত হন, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে। ধাপে ধাপে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত।

জুলাই ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উত্তাল সময়। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা এক  ভাষণে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাজাকার’ বলে আখ্যায়িত করলে প্রতিবাদ চরমে পৌঁছায়। এর পরদিন, ১৫ জুলাই, ছাত্রলীগ ও তাদের সমর্থিত ক্যাডার বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী মারাত্মকভাবে আহত হন। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ওপর বর্বরোচিত হামলার ছবি সারাদেশে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রী হল থেকে ছাত্রীদের মিছিল রাস্তায় নামে। তারা ছেলেদেরকেও আহ্বান জানায়, এবং পূর্ণ মাত্রায় আন্দোলন শুরু হয়। সেই মুহূর্তে আন্দোলনের মূল দাবি কোটা সংস্কার নয়, বরং সরকারের পতন। এই ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের ফলস্বরূপ, অবশেষে ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগ করতে হয় এবং আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়।

সরকার পতনের পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দেশের কাঠামোগত সংস্কারের দাবি জানায়। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়, যেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনুস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দুই ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত হন, তবে দুঃখজনকভাবে উভয়েই ছিলেন পুরুষ। সরকারে কোনও নারী উপদেষ্টার অন্তর্ভুক্তি না হওয়ায় দেশজুড়ে বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল সমালোচনার সৃষ্টি হয়। যারা আন্দোলনের সময় দৃশ্যমান ভূমিকা রেখেছিলেন, সেই নারীদের উপস্থিতি পরবর্তী পর্যায়ে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত ছিল।

রাজনীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের কম অংশগ্রহণের প্রধান কারণ হলো সামাজিক বাধা। তারা সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হয়, যাদের পুরুষদের সমান লক্ষ্য অর্জনের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। যখন আমরা সামাজিক বাধার কথা বলি—তদুপরি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের আচরণ ও পোশাক নিয়ে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা আরও জোরদার হতে দেখা যাচ্ছে। পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় সমাজে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর ও মৌলবাদীদের ভূমিকা আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, যার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয় নারীরা। সম্প্রতি ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রকাশ্যে ধুমপানের কারণে দুই তরুণী নিগৃহীত হন। এই ঘটনা উল্লেখ করার পূর্বে বলে নেওয়া শ্রেয় যে, প্রকাশ্য ধুমপান বাংলাদেশে দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু নারী ও পুরুষের ধুমপানের ঘটনা নতুন নয়, কিন্তু নারীর বিরুদ্ধে এই মাত্রায় প্রতিক্রিয়া এর আগে দেখা যায়নি। মোহাম্মদপুর ঘটনায় দুই তরুণীর ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, এবং তাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত বিদ্বেষ তৈরি করা হয়। এর মধ্যে একজন ছিলেন সেই নারী, যিনি জুলাই বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আরেকটি আলোচিত ঘটনায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ‘অশালীন পোষাক’ পরার অভিযোগে এক ব্যক্তি প্রকাশ্যে হেনস্তা করে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলেও, পরে “ধর্মীয় মূল্যবোধ” এর নামে একদল লোক তাকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। এটি ছিল নারীর বিরুদ্ধে অপরাধকে ধর্মীয় মোড়কে বৈধতা দেওয়ার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। এছাড়াও, দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্প্রতি একটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ফেসবুকে প্রকাশিত কনটেন্ট বিশ্লেষণ করে পরিচালিত এক গবেষণায় নারীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সুপরিকল্পিত বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার প্রমাণ মিলেছে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, নারী রাজনীতিক, সাংবাদিক ও অধিকার কর্মীদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে লিঙ্গভিত্তিক কুৎসা ও অপপ্রচার চালানো হয়েছে। যদি নির্বাচনের আগেই এই পরিস্থিতি থাকে, তবে সরকার পতনের পর যে চিত্র আমরা দেখেছি, তা নিঃসন্দেহে আরও ভয়াবহ। বিপ্লব-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলার শূন্যতা এবং অস্থির পরিবেশ নারীদেরকে করেছে আরও বেশি অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নিরাপত্তার অভাবে নারীরা একদিকে যেমন সরাসরি সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে “মোরাল পুলিশিং” ও চরিত্র হননের চেষ্টা যেন আরও বেশি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এই বাস্তবতা শুধু নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নয়, বরং সমাজে তাদের স্বাধীন অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলছে। 

এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় ভিন্নতর। যদিও দেশে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি, তবুও তারা অর্থনীতিতে সমানভাবে অবদান রাখতে পারছেন না। শিল্পবিপ্লব নারীদের উৎপাদনশীল খাতে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করলেও, বাংলাদেশে এই পরিবর্তন অনেক বিলম্বে এসেছে। গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের সময় নারীরা কর্মক্ষেত্রে আসতে শুরু করেন। এর ফলে তারা এখনও উৎপাদনশীল নিম্নবর্গের শ্রমিক হিসেবে বিবেচিত হলেও, নীতি-নির্ধারণ পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি নগণ্য।

যদিও দেশের ইতিহাসে নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং স্পিকার ও নারী ছিলেন, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নারী দ্বারা গৃহিত হয়েছিলো, এইটা বলা যাবে না। রক্ষনশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা এখনও ঘরের বাইরের কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাজনীতির মতো চ্যালেঞ্জিং ক্ষেত্রে, প্রবেশ করতে পারেন না। অথচ ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে নারীরা সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যার প্রধান দাবি ছিল সরকারের পতন। তবে এই অর্জনের পর, নারীদের আরও ক্ষমতায়িত হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে উল্টো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং বাস্তব জীবনে নারীদের প্রতি সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার নামে একটি গোষ্ঠী নারীদের উপর নৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে, যেন তারা “শালীনভাবে” আচরণ করে। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়েই চলেছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এর প্রতিরোধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের রাজনৈতিক সাংগঠনিক সংস্কৃতির সহিংস ও বর্জনমূলক চরিত্র। এই সংস্কৃতি শুধু পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখে না, বরং নারীদের সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক পরিসর থেকে সরিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও নারীরা অনলাইন ও অফলাইন—উভয় ক্ষেত্রেই যে ভয়ভীতি, অপমান ও হয়রানির শিকার হন, তা আকস্মিক নয়; বরং এটি একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুৎসা রটানো থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শারীরিক লাঞ্ছনা—এ সবই নারীদের মনোবল ভেঙে তাদেরকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কৌশল। এভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনকে পুরুষ-প্রধান ও নারীবর্জিত করে রাখাই যেন দীর্ঘদিন ধরে লালিত হয়ে আসা একটি অঘোষিত নীতিতে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তরুণ নারীদের পরিবার তাদের রাজনৈতিক বা সামাজিক কর্মে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করছেন।

জুলাই বিপ্লবে নারীরা ভিন্নমতাবলম্বী হলেও একই প্ল্যাটফর্মে একত্রিত হয়েছিলেন। তখন পোশাক বা ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে কেউ অবদমিত হননি। কিন্তু বিপ্লবের সফলতার পর, পুরুষ নেতৃত্বই কেন্দ্রে চলে আসে এবং নারীদের পিছনে ফেলে দেয়। ফলে নারীরা বিচারিক দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক ও ডিজিটাল মাধ্যমে, ক্রমাগতভাবে পরাজিত হতে থাকেন। 

এই কারণেই পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে। বিপ্লবে নারীদের ভূমিকা ছিল অভূতপূর্ব, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এবং নতুন রাজনৈতিক দলসমূহ সেই নারীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ত হওয়ার পরিসরে সুযোগ দেননি। এখনও নারীদের শুধু উৎপাদনশীল ‘শ্রম’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে দেশ পরিচালনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়ার জায়গাটি তাদের জন্য সুরক্ষিত নয়। তাই প্রথাগত প্রতিবন্ধকতাগুলো ভাঙার জন্য যদি সচেতন ও সংগঠিত উদ্যোগ গ্রহণ না করা হয়, তবে নারীর কণ্ঠ বরাবরের মতোই উপেক্ষিত ও প্রান্তিক থেকে যাবে। এই উপেক্ষা শুধুই একটি সামাজিক অসংগতির প্রতিফলন নয়, বরং তা একটি অযাচিত বৈষম্য, যা গণতান্ত্রিক চেতনা ও প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির মৌলিক আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই ব্যবধান দূর করা শুধু ন্যায্যতার প্রশ্ন নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। নারী যদি রাজনৈতিক পরিসরে সমানভাবে উপস্থিত না থাকেন, তবে কোনও সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে কোনোদিনই প্রতিনিধিত্বশীল হতে পারবে না।


Comments

  • 16 Jul 2025, 11:56 AM

    sdfdsf