ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের লক্ষ্য ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি
15 January 2023যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ বলেছেন, বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই আইনের একটি ধারায় বর্ণিত অপরাধ সংঘটনে কেউ যদি সহযোগিতা করে তবে তাকেও অভিযুুক্ত করা যাবে। আর এই ধারাতেই সবচেয়ে বেশি মামলা হচ্ছে। এক ওয়েবিনারে তিনি বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের দু’টি দিক খুবই বিপজ্জনক। প্রথমত, যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেই জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা নেই। নাগরিক সমাজকে দুর্বল করতে করতে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে কথা বলার সুযোগ খুবই সীমিত। গণমাধ্যমের ওপরও নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে।
বর্তমানে নজরদারি বা আড়িপাতার জন্য যেসব সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে তাতে কোনো স্বচ্ছতা নেই উল্লেখ করে ড. রিয়াজ বলেন, সরকার সার্বক্ষণিকভাবে একটি ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে যাতে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস না পায়। এই আইনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পৃক্ত একটি গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে।
‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৮-কি ঘটছে’ বিষয়ক এক ওয়েবিনারে মুখ্য আলোচক অধ্যাপক রিয়াজ এসব কথা বলেন। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিস (সিজিএস) ওয়েবিনারটির আয়োজন করে। এতে অংশ নেন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান, গ্লোবাল টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, বাংলা ট্রিবিউনের বার্তা প্রধান মাসুদ কামাল এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল’র সিনিয়র লেকচারার সাইমুম রেজা তালুকদার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিজিএসের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
ড. রিয়াজ বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সহিংসতার একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) অ্যাক্ট সংশোধনের কথা বলে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যার পরিণতি আরো খারাপ হয়েছে। তিনি বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো তথ্যপ্রযুক্তিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে ফেসবুক ব্যবহার করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণকারী টেক জায়েন্টরা অনেক ক্ষেত্রে করপোরেট স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাই টেক জায়েন্টদেরও জবাবদিহিতার প্রয়োজন রয়েছে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনমত প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম। তাই এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করাটা জরুরি।
অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাংলাদেশের সংবিধান, তথ্য অধিকার আইন ও প্রচলিত ফৌজদারি দণ্ডবিধির সাথে সাংঘর্ষিক। সংবিধান বাংলাদেশের জনগণকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। তাই এর সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন হতে পারে না। দমন-নিপীড়নের হাতিয়ার এই আইনটি সরকারকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই আইনের কুফল যাতে বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের ভোগ করতে না হয়, সেদিকটিও বিবেচনায় রাখা উচিত।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে সবচেয়ে বেশি মামলা হচ্ছে উল্লেখ করে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ওয়াজসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অন্যের ওপর আঘাতের ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ দেখি না। প্রগতিশীলরা যতটা এই আইনের আওতায় এসেছেন, প্রতিক্রিয়াশীলরা ততটা আসেননি।
মাসুদ কামাল বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মাধ্যমে ভয়ের একটি আবহ তৈরি করে রাখা হয়েছে। সরকার সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হচ্ছে না। বিশেষ একটি শ্রেণীকে দমনের জন্য আইনটি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, জননিরাপত্তার কথা বলে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই আইন অবিলম্বে বাতিল করা প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে করা মামলাগুলোর ওপর গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন ড. রিয়াজ। এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি বা অবমাননা করার জন্য এই আইনে মোট ১৪০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ২১টি, স্বতন্ত্র ব্যক্তি ১১৯টি এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টরা ৬৪টি মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলায় ২১০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আটক হয়েছেন ১১৫ জন। মন্ত্রীদের কটূক্তি, অবমাননা বা মানহানির জন্য মোট ৬৪টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা চারটি, মন্ত্রী বা তার পরিবারের সদস্যরা ছয়টি এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিরা ৫৪টি মামলা দায়ের করেছে। এ সব মামলায় ১৩০ জনকে অভিযুক্ত এবং ৫১ জনকে আটক করা হয়েছে। রাজনীতিবিদদের কটূক্তি, অবমাননা বা মানহানীর জন্য মোট ১৬৮টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পাঁচটি, রাজনীতিবিদরা ৬৯টি এবং তাদের সমর্থকরা ৯৪টি মামলা করেছে। এ সব মামলায় ৪৭০ জনকে অভিযুক্ত এবং ১২০ জনকে আটক করা হয়েছে। ফেসবুকে পোস্ট দেয়া বা শেয়ার করা এবং মন্তব্য করার জন্য ৬৯৮টি মামলায় মোট এক হাজার ৪৮৯ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য ১১৫টি মামলায় মোট ১১৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
News Courtesy: