শরৎকালেও গ্রীষ্মের গরম

ইফতেখার মাহমুদ | 28 August 2021
No image


অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর থেকে দিনের বেলা শীতকাল হারিয়েই গেছে।

এখন শরৎকাল। এই সময়ে আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি আর দমকা হাওয়া থাকার কথা। কিন্তু ঢাকায় এখন গ্রীষ্মকালের মতো ঠা ঠা রোদ আর রাতে ভ্যাপসা গরম। মৌসুমি বায়ু এখনো বিদায় নেয়নি। তাই মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে। তাতে শহরের উষ্ণতা কিছুটা কমছে, কিন্তু বৃষ্টি শেষে আবারও সেই অস্বস্তিকর আবহাওয়া।

আগস্টে দেশের পাঁচটি প্রধান শহরে দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যেখানে থাকার কথা ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে থাকছে ৩৪ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টিতে তাপমাত্রার খুব বেশি হেরফের হয়নি। গত এপ্রিল থেকে এই সময় পর্যন্ত দিনের বেলা গ্রীষ্মের সময়ের তাপমাত্রাই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট—এই পাঁচ প্রধান শহরের তাপমাত্রার পরিবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমেও রাজধানীসহ এই শহরগুলোর দিনের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালের মতো উত্তপ্ত থাকে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর থেকে দিনের বেলা শীতকাল হারিয়েই গেছে। এই দুই শহরে শীতকালে দিনের বেলা শরৎকালের মতো আধা উষ্ণ তাপমাত্রা থাকছে। গত ১৬ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটের তাপমাত্রা বেড়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় গড়ে ৩ ডিগ্রি আর চট্টগ্রামে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে।

বাংলাদেশে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কে শীতকাল ধরা হয়। এই সময়ে ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকার কথা। চট্টগ্রামে ১৩ থেকে ১৬ ডিগ্রি। শীতে কোনো এলাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে সেখানে শৈত্যপ্রবাহ হচ্ছে বলে বলা হয়। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় শীতকালে ছয় থেকে দশটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। এই দুই শহরে গত পাঁচ বছরে শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। শীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি থাকছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবরের বাসিন্দা আবদুর রহমান গরমের উত্তাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) লাগিয়েছেন। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় একসময়ের বিলাসী পণ্য এসি এখন আর সেই তালিকায়ও থাকছে না।

গবেষণা দলের দলনেতা ও কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনায় শুধু বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বড় শহরগুলোর অভ্যন্তরীণ কারণে বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা যোগ হচ্ছে না। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলো ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে উঠছে। পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ ও জলাভূমি না করতে পারলে এই শহরগুলোকে বসবাসের উপযোগী রাখা যাবে না।

চলতি মাসে প্রকাশিত বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের প্যানেল-আইপিসিসির ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এই শতাব্দীর মধ্যে তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে না বাড়ে, সে ব্যাপারে প্যারিস চুক্তির আওতায় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো কাজ করছে। অথচ ঢাকাসহ দেশের প্রধান পাঁচটি শহরের তাপমাত্রা গত ১৬ বছরে ৩০০ বছরের বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশি।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা কতটা বেড়েছে, তা বিশ্লেষণ করে গবেষণাটি করা হয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে এসব শহরে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় ঋতুচক্রের এ পরিবর্তন ঘটছে বলে গবেষণাটিতে বেরিয়ে এসেছে। চলতি মাসে বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স ডাইরেক্ট গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণার জন্য ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিদিনের চারটি সময়ের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ওই পাঁচ শহরের সকাল সাড়ে ১০টা, বেলা দেড়টা আর রাত সাড়ে দশটা ও দেড়টার তাপমাত্রা স্যাটেলাইট থেকে চিত্র ও তথ্য–উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ওই পাঁচ নগরে শীতের সময়ে রাতে ও দিনের তাপমাত্রায় খুব বেশি পার্থক্য থাকছে না। ফলে গরম কাপড় কম পড়তে হচ্ছে। ঘরে বেশির ভাগ সময় বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করতে হচ্ছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। এতে নগরবাসীর ব্যয় ও বিদ্যুৎ খরচ বেড়েছে। আর বিদ্যুৎ ব্যবহারে বেড়ে গেছে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণও।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের বিদ্যমান জলাভূমি ও সবুজ এলাকা রক্ষা, রাজধানীর খালগুলো দখলমুক্ত করে সবুজায়ন এবং বাড়ির ছাদে বাগান করলে ১০ শতাংশ গৃহ কর মওকুফ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মেয়রের আশা, এতে রাজধানীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমে আসবে।

অবশ্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে ঢাকা শহরের ৬৫ ভাগ কংক্রিট বা অবকাঠামোতে আচ্ছাদিত ছিল। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় প্রায় ৮২ ভাগ। এই সময়ে জলাশয় ও খোলা জায়গা প্রায় ১৪ ভাগ থেকে কমে ৫ ভাগের নিচে নেমেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য নগরগুলোর শীর্ষে থাকছে। চট্টগ্রামসহ অন্য বড় শহরগুলোতেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এভাবে বেশি দিন চলতে থাকলে দেশের বেশির ভাগ বড় শহর ঢাকার মতো বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠবে।

News Courtesy:

https://www.prothomalo.com/bangladesh/%E0%A6%B6%E0%A6%B0%E0%A7%8E%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%93-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%AE

Comments