অব্যবস্থাপনায় ডুবে আছে ‘ডুবুরি প্রকল্প’

আসিফুর রহমান, সুকান্ত হালদার | 29 August 2021
No image


ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ২০১৮ সালে দেশের জলভাগ ও নৌ-রুটে দুর্ঘটনায় কবলিত ব্যক্তিদের উদ্ধারে তিন বছর মেয়াদী 'ডুবুরি ইউনিট সম্প্রসারণ'র উদ্যোগ নেয়, যেটি গত জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ।

প্রকল্পের সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও মূল সরঞ্জামাদির কোনোটিই তারা সংগ্রহ করতে পারেনি। যেগুলো সংগ্রহ করেছে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই আবার ওয়ারেন্টির মেয়াদ প্রায় শেষের পথে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

আইএমইডি'র প্রতিবেদন অনুযায়ী, মূলধন ব্যয় খাতের মাত্র ১৬ ভাগ ব্যয় হলেও যোগাযোগ খাত ও অফিস সরঞ্জামাদি খাতের সব টাকাই ব্যয় হয়েছে। যার মধ্যে ৫৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প পরিচালকের একটি গাড়িও রয়েছে, যেটি প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রথম বছরেই কেনা হয়েছে।

সারাদেশের মাত্র ৫০ জন ডুবুরি নিয়ে নৌ-পথে দুর্ঘটনায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষকে বেশ ভুগতে হয়।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় দুই নৌকার সংঘর্ষে অন্তত ২২ জন পানিতে ডুবে মারা গেছেন। আর এর আগের দিন রাজধানীর আজিমপুরে পুকুরে ডুবে মারা যায় দুই জন শিশু।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, দেশে বছরে শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশই পানিতে ডুবে মারা যায়। আর প্রতিবছর পানিতে ডুবে মারা যায় ১৮ হাজার মানুষ।

মেয়াদ শেষেও প্রকল্পের কাজ এগুচ্ছে না

১৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের এই প্রকল্পটি ৪ নভেম্বর ২০১৮ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

নৌ-রুটে দুর্ঘটনায় কবলিত ব্যক্তি ও যানের অবস্থান শনাক্ত করা, আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির সঙ্গে ডুবুরিদের পরিচিত করা এবং সর্বোপরি পানিতে ডুবে মৃত্যু কমানোর অংশ হিসেবে এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল।

প্রকল্পের আওতায় সাভারের আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, খুলনা, বরিশাল ও রংপুরের সাতটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশনকে আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম দ্বারা সজ্জিত করার কথা।

এই সরঞ্জামাদির মধ্যে ছিল একটি স্যালভেজ টাগ, সাতটি পন্টুন ও জেটি, ১৪টি হ্যাভি ডিউটি রেসকিউ বোট, ১৪টি লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট, সাতটি রেসকিউ ভেহিক্যাল, ৪২টি ডাইভিং এ্যাপারেটাস সেট, সাতটি এয়ার কমপ্রেসার মেশিন, রেসকিউ বোট পরিবহনের জন্য সাতটি লাইট ট্রাক ইত্যাদি।

গত জুনে প্রকাশিত আইএমইডি'র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এগুলোর মধ্যে মাত্র ১৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ সরঞ্জাম সরবরাহের টেন্ডার হয়েছে। সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) মোট প্রকল্পের ৬৮ ভাগ বাদ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মূলধন খাতের মোট ৪৫টি সরঞ্জামের মধ্যে জায়গার সংকট ও রক্ষণাবেক্ষণের জনবলের অভাবে স্যালভেজ টাগ, পন্টুন ও জেটিসহ মোট ১৭টি সরঞ্জাম বাদ দেওয়া হয়েছে। দুটি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আছে, ১০টি চুক্তি সই হয়েছে, নয়টি টেন্ডারের জন্য দেওয়া হয়নি আর মাত্র সাতটি সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে।

এদিকে, সরঞ্জামাদি বাদ দেওয়ার পর প্রজেক্টের আকার দাঁড়িয়েছে ৬৩ কোটি চার লাখ টাকা।

আইএমইডি বলছে, সংগৃহীত সরঞ্জামগুলোও প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরে রাখা হয়েছে, যেগুলো মূলত যেসব এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেখানে থাকার কথা। এরমধ্যেই যন্ত্রগুলোর ওয়ারেন্টি সময়সীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে।

প্রকল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ডুবুরি নিয়োগ করার কার্যক্রম এখনো শুরুই হয়নি।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন দায়ী করেন চলমান করোনা মহামারিকে। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর জন্য সংশোধিত প্রস্তাবসহ ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।'

আর ডুবুরি নিয়োগের বিলম্বের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, 'এর আগে প্রতি জেলায় ছয় জন করে ডুবুরি নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেটি অর্থ মন্ত্রণালয় ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন জেলা প্রতি তিন জন করে ডুবুরি নিয়োগের জন্য আবার প্রস্তাব পাঠানো হবে।'

অগ্রিম টাকা দিয়ে অর্থ ঝুঁকিতে

১৪টি হ্যাভি ডিউটি রেসকিউ বোট তৈরি করে দেওয়ার জন্য খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৯ সালের ১৮ জুন ১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকার চুক্তি করে ফায়ার সার্ভিস।

২০২০ সালের ১৭ জুন কাজ সম্পাদনের শর্ত সাপেক্ষে চুক্তি হয়। তবে, এখন পর্যন্ত তারা বোট সরবরাহ করেনি।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের অডিট আপত্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, চুক্তি মূল্যের ৯৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৮ কোটি ৯৯ লাখ ৯৫ হাজার ৭২৫ টাকা চুক্তি সম্পাদনের সঙ্গে পরিশোধ করে প্রকল্পের অর্থকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। আইএমইডি'র প্রতিবেদন বলছে, অডিট আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

যদিও প্রকল্প পরিচালক মোশারফ হোসেনের দাবি, তারা নিয়ম মেনেই কাজ করেছেন।

তিনি বলেন, 'খুলনা শিপইয়ার্ড যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান, তাই আমরা তাদের কাছ থেকে নিয়ম মেনেই কিনেছি। এখানে এক সরকারি প্রতিষ্ঠান আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিয়েছে। এতে করে অর্থ ঝুঁকিতে ফেলার কিছু নেই।'

মোশারফ হোসেন জানান, ইতোমধ্যেই তারা বোটগুলো পরিদর্শন করেছেন। বোটগুলোর কিছু ত্রুটি সংশোধন করতে বলা হয়েছে, তাছাড়া কিছু জিনিস দেশের বাইরে থেকে আনতে হবে।

কিন্তু শুধু হ্যাভি ডিউটি রেসকিউ বোটই নয়, প্রকল্পের মেয়াদ শেষে ১৪টি লাইট-ডিউটি বোটও কেনা হয়নি।

আইএমইডি'র আপত্তি, তারা লাইট ডিউটি বোটগুলোর জন্য চুক্তিই করেছে প্রকল্পের মেয়াদের চেয়ে বেশি সময়ের মধ্যে, যেটি ক্রয় পরিকল্পনার পরিপন্থী।

অন্যদিকে, প্রকল্প পরিচালকের দাবি, বোটগুলো মালয়েশিয়া থেকে আনা হবে, কিন্তু সেগুলো আনার জন্য বড় জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ সেগুলো আসতে পারে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সংগৃহীত যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'গত বছরের জুন-জুলাইতে সেগুলো কেনা হয়েছে। আর ওয়ারেন্টি মেয়াদ আরও এক বছর আছে, ওই মেয়াদের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।'

আইএমইডি'র পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-১ এর প্রধান ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান বলেন, 'যখন কোনো প্রকল্পের কাজ শুরু হয় তখন আইএমইডি ইন্টারনাল জুরিসডিকসন অনুযায়ী মনিটরিং করে।'

তিনি বলেন, 'প্রকল্পের কোনো ত্রুটি পাওয়া গেলে আমাদের সুপারিশ ও পর্যবেক্ষণ থাকে। সেগুলো বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষকে জানাই। তাদের ফিডব্যাক পাওয়ার পর বা ফিডব্যাক না পেলেও পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।'

বিশেষজ্ঞদের মতে, ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে ডুবুরিদের অন্তর্ভুক্ত করা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। যদিও এর জন্য পর্যাপ্ত জনবলের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দরকার।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) ডেপুটি নির্বাহী পরিচালক আমিনুর রহমান বলেন, 'পানিতে ডুবে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না। এটি নির্ভর করে কত দ্রুত তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসা যায় তার ওপর।'

'তবে ফায়ার সার্ভিসে ডুবুরি নিয়োগ অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। তাদের যদি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল থাকে, তবে নৌ দুর্ঘটনা বা বন্যার মতো জরুরি প্রয়োজনে এটা অবশ্যই কাজে আসবে। আরও বেশি সংখ্যক মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে', বলেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা সব যন্ত্রপাতি চলতি বছরের নভেম্বর মাসের মধ্যেই সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন।

তিনি বলেন, 'পানিতে ডুবে মৃত্যুহার কমাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্ধার অভিযান পরিচালনাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমাদের এই বিভাগে আরও জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকতো, তাহলে আরও দ্রুততম সময়ে সাড়া দেওয়া যেত। আশাকরি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা কমবে।'

News Courtesy:

https://bit.ly/3kyfT03

Comments