ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কেড়ে নিয়েছে নিরাপত্তা
01 October 2021সাইবার অপরাধ দমনে ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন করা হয়। ওই আইনের ৫৭ ধারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার আইনটি সংশোধনের আশ্বাস দিলেও পরে ২০১৮ সালের অক্টোবরে উল্টো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) নামে আরও কঠোর আইন করে। সময়ের হিসেবে আজ শুক্রবার এই আইনের তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে। সাংবাদিক, রাজনীতিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা শুরু থেকেই এই আইন বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার লেখক মোশতাক আহমেদ কারাগারে মারা যান। একই মামলায় কার্টুনিস্ট কিশোরও বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন।
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের বিস্তার ঘটছে। এটি দমনে যেমন আইন দরকার, তেমনি এর যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় সুশীল সমাজ মনে করছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। এই আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশকে পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সমাজের বিত্তবান বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ করলেই সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হচ্ছে। দেশের প্রচলিত দণ্ডবিধি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এসব মামলা হচ্ছে।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যবেক্ষণমূলক একটি ফলাফলে জানায়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি
থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৬৮ মামলার বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে, ২৫ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার ৪৯৯ জনের মধ্যে ৪২ জন সাংবাদিক।
স্থানীয় পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় গত বছরের ১ মে নরসিংদীর তিন সাংবাদিক রমজান আলী প্রামাণিক, শান্ত বণিক ও খন্দকার শাহীনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। স্থানীয় সাংসদ সম্পর্কে প্রতিবেদন করায় ‘দৈনিক আমার হবিগঞ্জ’ পত্রিকার সম্পাদক সুশান্ত দাশগুপ্তকে আরেকজনের দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় মানহানির বিচার করা হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করেন, তজ্জন্য তিনি অনধিক তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কারাদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
দণ্ডবিধির ৫০০ থেকে ৫০১ ধারায় এই মানহানির বিচার হয়। প্রত্যেক ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড। সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও রয়েছে, তবে পরিমাণ উল্লেখ নেই।
একই অপরাধে একই সঙ্গে দুই আইন বলবৎ থাকাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করছেন আইনজ্ঞরা। দণ্ডবিধিতে মানহানির শাস্তি দুই বছর কারাদণ্ড। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড। আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, একই ধরনের অপরাধে দণ্ডবিধি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বিধান সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, একই অপরাধের জন্য দুটি আইন পাশাপাশি চলতে পারে না।
দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারার আরও অসামঞ্জস্য রয়েছে। মানহানি-সংক্রান্ত দণ্ডবিধির ৫০০ থেকে ৫০২ ধারার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া আটক করা যাবে না। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
দণ্ডবিধির তিন ধারার অপরাধ বিচার হয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানহানির মামলার বিচার হয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা অনুযায়ী, মানহানির ক্ষেত্রে যিনি সংক্ষুব্ধ তিনি ছাড়া অন্য কেউ মামলা করতে পারবে না। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পক্ষে কেউ মামলা করলেই সেটি গ্রহণ করা হয়।
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, গ্রেপ্তারের অবাধ ক্ষমতা দেওয়ায় পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানহানির মামলায় সাংবাদিক ও অন্যদের যখন-তখন গ্রেপ্তার করছে। আবার ট্রাইব্যুনালও এসব মামলা আমলে নিচ্ছে।
News Courtesy: