ডিজিটাল নিরাপত্তায় উন্নত গণতন্ত্র ও আমরা

কামাল আহমেদ | 19 August 2023
No image

আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের নিপীড়ণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে বলে সমালোচনার মুখে এখন তাতে নামমাত্র পরিবর্তন করে করা হচ্ছে সাইবার আইন। তবে সরকারের যুক্তি একই আছে। আর সেটি হচ্ছে উন্নত দেশগুলোতেও এই আইন আছে। ইন্টারনেটে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর তথ্য প্রকাশ, মানহানি এবং শান্তি–শৃঙ্খলা নষ্ট হতে পারে এমন কিছুর প্রকাশ ও প্রচার বন্ধের প্রয়োজনে আইনটি করা হয়েছে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। আইনটির শুরুতেই এটি প্রণয়নের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, ”ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়।”

গত ২৩ মে ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা কিন্তু শুধু বাংলাদেশে না, এটা কিন্তু পৃথিবীর সব দেশেই আছে। আমেরিকায়ও আছে, তারপর ইংল্যান্ডে আছে, সব দেশেই কিন্তু নেওয়া আছে।’ ওই সাক্ষাৎকারে অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমেরিকার ডিজিটাল আইনে কী আছে, যুক্তরাজ্যের আইনে কী আছে সেগুলো তাঁর সরকার দেখবে। এরপর তিনি যোগ করেন, সেখানে যদি আমরা দেখি, আমাদের আইনের থেকেও কঠিন কোনো শাস্তির ব্যবস্থা আছে সেটাও আমরা সংস্কার করে দিব।  

আমেরিকা ও ইউরোপের আইন সম্পর্কে বাংলাদেশে খুব বেশি একটা আলোচনা শোনা যায় নি। তাছাড়া, সংসদে আইনটি যেভাবে অনুমোদিত হয়েছে, তাতে উল্লেখযোগ্য কোনো বিতর্কের অবকাশ ছিল না। ২০১৮ সালে যে সংসদে আইনটি পাশ হয়, সেই সংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় গঠিত হওয়ায় তাতে প্রকৃত বিরোধীদলের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর বক্তব্য শুনলেও সরকার তার কিছুই গ্রহণ করেনি। ইন্টারনেটে নিয়মনীতি আরোপের লক্ষ্যে সরকার যে তথ্য প্রযুক্তি আইন করেছিল, তার বিতর্কিত ও নিবর্তনমূলক ৫৭ ধারার অত্যধিক অপব্যবহারের কারণে দেশ–বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার ওই আইনটি বাতিল করে। তার জায়গায় আনা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, কিন্তু পূর্ববর্তী আইনের অনেক কিছুই নতুন আইনে রেখে দেওয়া হয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে বরং আইনটিকে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনমূলক রুপ দেওয়া হয়। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে যে নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ও তার খসড়া প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আইনের উদ্দেশ্য একই বলা আছে।

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন হুবহু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নকল না হলেও অপরাধগুলোর সংজ্ঞা অপরিবর্তিত আছে এবং অধিকাংশ ধারাতেই সাজাও এক। কয়েকটি ক্ষেত্রে সাজা কমেছে, কিছু ক্ষেত্রে অপরাধ জামিনযোগ্য হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি হিসাবে যে প্রতিষ্ঠানকে আইনটি প্রয়োগে তদন্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, মূলত সেটির নাম বদলে সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি করা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা বা সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে উন্নত বিশ্বে অনেকদিন ধরেই কাজ হচ্ছে। ঐসব দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কয়েকটি দিক স্পষ্টভাবে আলাদা করা যায় এবং আইনকানুন ও নীতিমালা তৈরি ও প্রয়োগে সতর্কতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতোই নাগরিকদের মানবাধিকারের সুরক্ষাকেও বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বলা চলে, মানবাধিকারকে সাইবার নিরাপত্তার কেন্দ্রে স্থান দেওয়া হয়। ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা ও মননের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের বিষয়ে আলাদা আইন আছে, যা সাইবার অপরাধ আইনের অংশ নয়। 

 প্রযুক্তির দ্রুত রূপান্তরের সঙ্গে তাল মেলাতে এসব অধিকারের সুরক্ষা দেওয়ার প্রক্রিয়াতেও এখন পরিবর্তন আসছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা দিতে যে জেনারেল ডাটা প্রটেকশন রেগুলেশন্স (জিডিপিআর) প্রণয়ন করে, তাকে ডিজিটাল জগতে অধিকার রক্ষার বিষয়ে সোচ্চার অধিকারকর্মীরা অনেকটা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড গণ্য করে থাকেন। বলা হয় এটি বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর ডিজিটাল তথ্যের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা আইন। ব্যবহারকারীর সম্মতি ছাড়া তার সম্পর্কে কোনো তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ , অন্য কারো কাছে হস্তান্তর ইত্যাদি নিষিদ্ধ করার এ আইনটি বিশ্বের যে কোনো দেশের কোম্পানি, যে প্রতিষ্ঠানের অনলাইন সেবা ইউরোপের সীমানায় পৌঁছাবে, তার ওপর প্রযোজ্য হয়। এই আইনের সাজা হচ্ছে জরিমানা, যার পরিমাণ দুই কোটি ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। এটি ২০১৬ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাশ হয় এবং ২০১৮ সালের মে মাস থেকে কার্যকর হয়। 

এই আইনের ভিত্তি হচ্ছে ১৯৫০ সালে গৃহীত ইউরোপীয় মানবাধিকার সনদ, যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ইইউতে জিডিপিআর প্রয়োগ ও তা লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্ত ও জবাবদিহির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন স্বাধীন নিয়ন্ত্রক ইইউ তথ্য কমিশনার। একইভাবে যুক্তরাজ্যে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্ত ও জরিমানার ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে স্বাধীন নিয়ন্ত্রক ইনফরমেশন কমিশনারের দপ্তর। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা সুরক্ষায় এসব আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকরিতা বোঝার জন্য দুটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করা যায়। ২০১৯ সালে বৃটেনে সরকারি খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশের সময়ে খেতাবপ্রাপ্তদের ফোন নম্বর ও ঠিকানা অসাবধানতাবশত প্রকাশ হয়ে পড়লে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ কেবিনেট অফিসকে তথ্য কমিশনার পাঁচ লাখ পাউন্ড জরিমানা করেন।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে টুইটারে একটি ত্রুটির (বাগ থাকায়) অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেম ব্যবহারকারীদের সীমিত টুইট কাঙ্খিত বন্ধু বা অনুসারীদের বাইরে অন্যদের কাছেও উন্মুক্ত হয়ে যায়। ফলে ইইউয়ের তথ্য কমিশনার টুইটারকে চার লাখ ইউরো জরিমানা করেন। অবশ্য বাংলাদেশেও আলাদা করে ডাটা সুরক্ষার আইন হচ্ছে, যার সম্ভবত পঞ্চম খসড়া সম্প্রতি সরকার প্রকাশ করেছে। 

 এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বৃটেনে আরও উন্নত ও নতুন আইন আসছে। প্রযুক্তি খাতে দ্রুত নতুন নতুন উদ্ভাবনের কারণে সেবার বৈচিত্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি অপরাধেরও প্রকৃতিতে পরিবর্তন দৃশ্যমান হতে থাকে। ফলে আইনের অতিবিস্তৃত কিম্বা অতিসংকীর্ণ সংজ্ঞায়নের কারণে বিদ্যমান আইন যথেষ্ট পরিমাণে সুরক্ষা দিতে পারছে না বলে অনুভূত হতে থাকে। ইতোমধ্যে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে গেছে।  নতুন আইনের প্রয়োজন সমানভাবেই অনুভূত হয়েছে। ইইউ প্রায় তিন বছর ধরে আলোচনা ও বিতর্কের পর গতবছরের ৫ জুলাই নতুন আইন তৈরি করেছে, যার নাম ‘দ্য ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট’ (ডিএসএ)। আর যুক্তরাজ্যে আইন কমিশন ২০১৮ সালে একবার এবং ২০২০ সালে আরো সম্প্রসারিত আকারে বিষয়টি নিয়ে গবেষণার পর তার সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করে, যার ভিত্তিতে ডিজিটাল সেফটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) নামে একটি আইনের খসড়া বর্তমানে পার্লামেন্টের বিবেচনাধীন আছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বরে তা অনুমোদন পেয়ে আইনে রূপান্তরিত হবে। ডিজিটাল সার্ভিসেস অ্যাক্টে ইইউ ভোক্তা তথা নাগরিকদের সম্ভাব্য নানারকম অপরাধের শিকার হওয়া ও ক্ষতি থেকে সুরক্ষা দিতে ডিজিটাল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব অনেক বাড়িয়েছে। বৃটেনে প্রস্তাবিত খসড়া নিয়ে এখন জোর বিতর্ক হচ্ছে।

 ইইউয়ের নতুন পাশ হওয়া ডিএসএতে মূলত বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব বেড়েছে, যাতে ভোক্তাদের ক্ষতির মুখে না পড়তে হয়। এতে আগে বিদ্যমান ডিজিটাল বাণিজ্য বিষয়ক আইনগুলোর অনেক কিছুই অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক স্বচ্ছ্বতা এবং ব্যবহারকারির সুরক্ষাই হচ্ছে এই আইনের মূল লক্ষ্য। আমরা অনলাইনে গেলে, যেমন ফেসবুক বা গুগলে অহরহ নানারকম বিজ্ঞাপন বা তথ্য পাই, কোনো কো্নোটি বারবার পর্দায় আসতে থাকে। এগুলো কেন হয়, কীসের ভিত্তিতে ঐসব কোম্পানি নির্দিষ্ট কিছু পণ্য, সেবা বা তথ্য আমাদের কাছে তুলে ধরে। ফেসবুক বা গুগল ব্যবহারকারী হিসাবে ইউরোপীয় নাগরিকদের কাছে তারা কী অ্যালগরিদম ব্যবহার করছে তা জানতে চাওয়ার অধিকার এই আইনে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্য স্পষ্ট সম্মতি ছাড়া অন্য কারো কাছে হস্তান্তর বা বিনিময় এ আইনে আরো কঠিন করা হয়েছে। একইভাবে সম্ভাব্য ক্ষতিকর তথ্য যেমন দ্রুত বেশি লাভের পনজি স্কিম কিম্বা নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত আর্থিক সেবার বিজ্ঞাপন বা তথ্য সরিয়ে দেওয়া বা মডারেট করার দায়িত্ব এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তাচ্ছে। কিন্তু এই মডারেশন কোনোভাবেই নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী হবে না। আইন লঙ্ঘনের আর্থিক সাজা অনেক বেশি, যা কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া করে দিতে পারে। 

সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে ইউরোপীয় কমিশন দুই যুগ আগে  ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তার যে সংজ্ঞায়ন করেছে, তা প্রায় সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ২২ বছর আগে ২০০১ সালের ২৩ নভেম্বরে সম্পাদিত বেলগ্রেড কনভেনশন পরে বিশ্বের ৬৮টি দেশ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান ও ইজরায়েলের মতো দেশগুলোও আছে। বেলগ্রেড সনদে ডিজিটাল নিরাপত্তার সংজ্ঞায়নে বলা হয়েছে, ইলেকট্রনিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং ইনফরমেশন সিস্টেম ব্যবহার করে অনলাইনে সংঘটিত অপরাধমূলক কাজ হচ্ছে সাইবার অপরাধ। সাইবার অপরাধের সংজ্ঞায়নে যেসব বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে তা হলো:. নির্দিষ্টভাবে ইন্টারনেটকে লক্ষ্য করে অপরাধ, অনলাইনে জালিয়াতি ও প্রতারণা, এবং ইন্টারনেটে বেআইনি আধেয়। বেলগ্রেড সনদকে ভিত্তি করে ইইউভুক্ত দেশগুলো নিজস্ব আইন করে তা অনুসরণ করে। সন্ত্রাসবাদ, মানব পাচার, শিশু যৌন নির্যাতন এবং মাদক পাচার সহ অনেক ধরনের অপরাধ এখন অনলাইনের সহায়তায় ঘটছে এবং অপরাধ সংঘটন সহজ হয়ে গেছে। ফলে ঐসব অপরাধ দমনের আইনেও তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহারের বিষয়গুলো অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। অনলাইনে সন্ত্রাসী কার্যক্রম মোকাবিলায় সন্ত্রাসবাদ দমন বিষয়ক আইন, মানবপাচারের অপরাধে অনলাইনের ব্যবহার মোকাবিলায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইন প্রয়োগ হচ্ছে। 

কম্পিউটার ,ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহার বিষয়েও বেশ কয়েকটি আইন আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে পুরোনো সম্ভবত বৃটেনের কম্পিউটার মিসইউজ অ্যাক্ট ১৯৯০। মূলত কোনো কম্পিউটারে অনধিকার প্রবেশ, তার তথ্যভান্ডার বা বিভিন্ন সিস্টেমস এর ক্ষতিসাধনের মতো অপরাধ মোকাবিলাই প্রধানত এর লক্ষ্য। ঐ আইনে পরে বিভিন্ন সময়ে কিছু সংশোধনী আনা হলেও তা এখনও বহাল আছে। অনলাইনে শিশুদের যৌন নিপীড়নের মতো ক্ষতিকর তথ্য ও আধেয় আদান–প্রদান, বিতরণ ও সংরক্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে ম্যালিশাস কমিউনিকেশন্স অ্যাক্ট ১৯৮৮ এবং ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো, সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের মতো তথ্য প্রচার ও বিনিময়ের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ আইন, কমিউনিকেশন্স অ্যাক্ট ২০০৩ কার্যকর আছে। 

 বৃটেনসহ উন্নত গণতন্ত্রে পুলিশ আইন প্রয়োগ করে স্বাধীনভাবে। একইভাবে সম্প্রচার তদারকি প্রতিষ্ঠান অফকম, কিম্বা ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত তথ্য কমিশনারের দপ্তর আইন প্রয়োগ করে স্বাধীনভাবে, যাতে সরকারের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা নেই। ফলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করা বা ভিন্নমত দমনের কোনো অবকাশ ওই আইনভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় নেই। তার উপরে পুলিশকেও পুলিশের জন্য নির্ধারিত তদন্ত পরিচালনার আলাদা আইন অনুসরণ করে তদন্ত, গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করতে হয়। তদন্তপ্রক্রিয়াতেও তল্লাশি ও আলামত জব্দ করার প্রক্রিয়ায় বিচারিক তদারকির ব্যবস্থা আছে, যাতে সন্দেহের যৌক্তিকতা দেখিয়ে আদালতের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন হয়।     

মানহানির মতো বিষয় কিম্বা রাজনৈতিক আদর্শ বা বিশ্বাস কিম্বা তত্ত্বকে সুরক্ষা দেওয়ার কোনো চেষ্টা পাশ্চাত্যের আইনে নেই। যুক্তরাষ্ট্র তো এক্ষেত্রে আরও উদার। কেননা, সেখানে বাকস্বাধীনতার প্রায় নিরঙ্কুশ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে। মানহানির অপরাধ অধিকাংশ দেশেই দেওয়ানি অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়, যা সাধারণত আর্থিক ক্ষতিপূরণের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা উস্কানির মত অপরাধের জন্য আছে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রতিরোধের আলাদা আইন।  

এসবের বিপরীতে আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং তার প্রস্তাবিত নতুন রূপ সাইবার আইনের পরিব্যপ্তি অনেক বেশি বিস্তৃত এবং সংজ্ঞায়ন অস্পষ্ট। সংজ্ঞায় যদিও বলা হয়েছে, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’’ অর্থ কোনো ডিজিটাল ডিভাইস বা ডিজিটাল সিস্টেম এর নিরাপত্তা; {ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮, ধারা ২(ট))} কার্যত তা এসব ডিভাইস ও সিস্টেমের নিরাপত্তা ছাড়াও এগুলো ব্যবহার করে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধকেও আইনের পরিধিভুক্ত করেছে। এই আইনে ব্যক্তির সুরক্ষার কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। কিন্তু রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের সুরক্ষার বিধান আছে, যা স্পষ্টতই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। আমাদের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও এই আইনে তা অনেকটাই এবং কঠোরভাবে সংকোচন করা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা তাই এরকম দুটি ধারা ২১ ও ২৮ বিলোপের সুপারিশ করেছেন। 

জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা একই সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারা যেমন মানহানি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা উত্তেজনা সৃষ্টির মতো অপরাধ দেশের বিদ্যমান অন্য আইনে থাকার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ফৌজদারি আইনে ঐসব অপরাধের যে সাজা নির্দিষ্ট আছে, ডিজিটাল আইনে সেই সাজা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অসঙ্গতি দূর করার সুপারিশও তাঁরা করেছেন। সম্পাদক পরিষদ এবং সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন অধিকার গোষ্ঠীও একইরকম পর্যবেক্ষণ ও দাবি জানিয়েছে। তারা মানহানিকে ফৌজদারি দায় থেকে মুক্ত করে দেওয়ানি অপরাধ হিসাবে গণ্য করার আহ্বান জানিয়েছে। প্রস্তাবিত সাইবার আইনেও মানহানি অপরাধ হিসাবে অর্ন্তভুক্ত হয়েছে, তবে সাজা হিসাবে শুধু ক্ষতিপূরণের বিধান করা হচ্ছে। অথচ, ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে প্রতিকারের নীতি গ্রহণ করায় এটি সহজেই এই সাইবার আইন থেকে বাদ দেওয়া যেত। 

আমাদের আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও অতি বিপজ্জনক বিধান হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি ও পুলিশ বা আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা, যার অপব্যবহার ইতিমধ্যেই লেখক মুশতাকের প্রাণহানিসহ অনেক ঘটনায় দেখা গেছে। কোনো ধরনের পরোয়ানা ছাড়া বা বিচারিক তদারকির ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার এড়ানো প্রায় অসম্ভব। আমাদের তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো – যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি কিম্বা বিটিআরসি– কোনোটিই স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার অধিকার রাখে না। বরং, সরকারের একটি অঙ্গ বা হাতিয়ার হয়ে আছে। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলা বা অদক্ষতার কারণে নাগরিকদের গোপনীয়তা ফাঁস হওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সেই প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা আমাদের আইনে নেই। 

পরিহাসই বলতে হবে যে ইউরোপ বা যুক্তরাজ্যের আইনের সঙ্গে আমাদের মিলটা শুধু আইনের নামকরণের সংক্ষিপ্ত রূপ ডিএসএতেই সীমিত। অন্যকিছুতে নয়, নাগরিকদের অগ্রাধিকারে তো নয়ই।

কামাল আহমেদ, প্রায় চার দশকের সাংবাদিকতা পেশায় তিনি যেসব দায়িত্ব পালন করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:  সাবেক পরামর্শক সম্পাদক, প্রথম আলো; সাবেক পরামর্শক, জাতিসংঘ রেডিও; সাবেক সম্পাদক, বিবিসি বাংলা। বর্তমানে তিনি নিয়মিত কলাম লিখছেন বাংলা দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে।

*লেখাটি ১৯ আগস্ট ২০২৩-এ সিজিএস আয়োজিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা, উন্নত গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পড়া হয়েছে।

*প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য সম্পূর্ণ লেখকের, এ বক্তব্য সি জি এস-এর নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।


Comments