বাংলাদেশে যুবরাজনীতি: বিক্ষোভ ও বাস্তবতা
আপন জহির | 04 March 2025
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরে একের পর এক ছাত্র আন্দোলন দেখা যাচ্ছে। কিছু সপ্তাহ আগে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার দাবিতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। এরপর মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের ছাত্ররা কর্মসংস্থানের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। এমন ধারাবাহিক আন্দোলনের কারণে রাজধানীতে প্রচণ্ড যানজটসহ অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কে বা কারা এসব আন্দোলন উসকে দিচ্ছে তা নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব শোনা যায়, কিন্তু কেন মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা, এমন পথে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে সে সম্পর্কে তেমন কোনো অর্থপূর্ণ আলোচনা নেই। প্রশ্ন হলো, দেশের তরুণ প্রজন্ম কি তাদের কথা বলার জন্য সবসময় রাস্তায় নামতেই বাধ্য থাকবে? এটাই কি আমাদের কাম্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি?
আন্দোলনের কারণ ও তরুণদের হতাশা
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ছাত্র আন্দোলনের পেছনে তরুণদের গভীর হতাশা ও ক্ষোভ কাজ করছে। জুলাইয়ের গণ-আন্দোলনের আগেই বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে যে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ক্রমশ আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিমুখ হয়ে পড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, বেশিরভাগ তরুণই রাজনীতির মৌলিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখে না এবং তারা মনে করে যে সাধারণ তরুণদের মতামত এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক শূন্যতায় হারিয়ে যায়। একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পরে এক ঝলক পরিবর্তনের আশা জেগেছিল বটে, কিন্তু এখন বাস্তবতা হলো অনেক তরুণই ব্যাপক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক কষ্ট এবং কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়াহীনতার কারণে হতাশ । সরকারের তরফ থেকে মতামত শোনার যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা তরুণদের কাছে পোশাকি ও অকার্যকর বলে মনে হয়; ফলে তাদের সমস্যাগুলো যে সমাধান হবে না, এ ধারণা শক্ত হচ্ছে।
তরুণদের রাজনৈতিক ধারণা নিয়ে করা একটি জরিপে দেখা গেছে যে দেশপ্রেম প্রবল থাকা সত্ত্বেও প্রায় ৯৫% তরুণ মনে করে রাজনীতিতে জড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ ও ফলহীন । এর প্রধান কারণ হিসেবে তারা দেখছে কোনো সহজলভ্য ও ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম নেই যেখানে তরুণরা নিরাপদে অংশ নিয়ে নিজেদের কথা নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং তার ভিত্তিতে বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারে। তরুণদের রাজনীতি সম্পর্কে হতাশাজনক দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রাখলে সাম্প্রতিক ছাত্র ও যুব আন্দোলনগুলোর পথ বেছে নেওয়ার কারণ কিছুটা হলেও বোঝা যায়। বাংলাদেশে সরকার ও সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে অরাজনৈতিক তরুণদের মধ্যে সরাসরি আলোচনার সুসংগঠিত প্ল্যাটফর্ম দীর্ঘদিন ধরেই অনুপস্থিত। তার ফলাফল হিসাবে, নীতি-নির্ধারণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ না পেয়ে তরুণরা বারবার রাস্তায় প্রতিবাদে নামছে—অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রতিবাদ সহিংস রূপ নিচ্ছে। তরুণদের অধিকার সচেতন ও প্রতিবাদী মনোভাব অবশ্যই ইতিবাচক; তবে যখন প্রতিবাদই তরুণ রাজনীতির একমাত্র ভাষায় পরিণত হয়, এবং বারবার সেই প্রতিবাদ সহিংস হয়ে ওঠে, তখন তা অধিকাংশ তরুণকে মূলধারার রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়ায়। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বদলে শুধু প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনই অভ্যাসে পরিণত হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
সরকার ও সুশীল সমাজের করণীয়
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে এখন সময় এসেছে তরুণ প্রজন্ম ও সরকারের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপের নতুন ফোরাম তৈরি ও সমর্থন করার। তরুণদের কথা শোনার এবং তাদের সমস্যার সমাধানে কাজ করার এটি একমাত্র পথ, যা আমাদের বারবার সংঘাতময় আন্দোলনের চক্র থেকে বের করে আনতে পারে । সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজ সবাই মিলে এমন পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে, যেখানে তরুণরা অহিংস পদ্ধতিতে তাদের মতামত তুলে ধরার সুযোগ পাবে। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি সেন্টার ও অনলাইন ডিজিটাল ফোরামগুলো তরুণ ও নীতিনির্ধারকদের মুখোমুখি আলোচনার ক্ষেত্র হতে পারে। একই সাথে নাগরিক সমাজকে সামনের কাতারে থেকে যুবসমাজের সাথে সরকার ও রাজনীতিবিদদের যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে।
উপরের লক্ষ্যগুলো অর্জনে নিচের পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:
● সরকারের উদ্যোগে তরুণ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নিয়মিত সংলাপের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা ও পৃষ্ঠপোষকতা করা – যেখানে সরাসরি মতবিনিময়ের মাধ্যমে সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে।
● বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি সেন্টার ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে উন্মুক্ত আলোচনার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা – এখানে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা তরুণদের মুখোমুখি হতে পারেন।
● নাগরিক সমাজের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত যুব-কেন্দ্রিক সংলাপ বা কলোকিয়াম আয়োজন করা – দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসব আলোচনায় তরুণরা তাদের মতামত ও দাবি সরাসরি তুলে ধরার সুযোগ পাবেন, এবং কর্তৃপক্ষও তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারবে।
● রাজনৈতিক দলগুলোর যুব শাখাগুলোকে নীতিনির্ধারণে তরুণদের অংশগ্রহণের প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করা – দলীয় কর্মসূচির বদলে সেখানে তরুণদের মতামতের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবদান রাখতে উৎসাহিত করা উচিত।
● শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে নাগরিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা – ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা যাতে শাসনব্যবস্থা, নাগরিক অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে মতপ্রকাশ ও অংশগ্রহণের গুরুত্ব শিখতে পারে। এভাবে তারা বড় হয়ে সংঘাতের পথে যাওয়ার আগেই গঠনমূলকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে।
উপরে বর্ণিত এসব উদ্যোগ তরুণদের শুধু প্রতিবাদমুখর হওয়ার আগেই রাষ্ট্রের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্কে আবদ্ধ করবে। সরকারের উচিত তরুণদের মতামতকে সমস্যা হিসেবে না দেখে জাতির ভবিষ্যৎ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা এবং তাদের কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা। নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোরও দায়িত্ব আছে তরুণদের এমন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়া, যেখানে তারা নিরাপদে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করতে পারে।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে তোলা
দীর্ঘমেয়াদে দেশের রাজনীতিতে গঠনমূলক রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যাতে তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিবাদে ফেটে পড়ার আগেই গণশুনানির মাধ্যমে সমাধান খোঁজা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দলীয় সংঘাত ও সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণপরিসর তৈরি করা জরুরি যেখানে তরুণরা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে এবং পরস্পরের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারে। রাজনৈতিক আলোচনাকে রাস্তাঘাটের সংঘাত থেকে বের করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি হল, অনলাইন ফোরামসহ উপযুক্ত পরিসরে (গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সদব্যবহারসহ) নিয়ে আসতে হবে । সেখানে মতের পার্থক্য থাকলেও তা সহিংস রূপ নেবে না; বরং আলোচনা ও যুক্তির মাধ্যমে সমাধানের পথ বের হবে।
এ বিষয়ে, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহায়তায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী ও যুবকদের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক প্রকল্পটি তরুণদের ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তরুণদের রাজনীতিতে অর্থবহভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে।
২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখাচ্ছে যে তরুণদের কণ্ঠকে উপেক্ষা করে রাখলে তারা শেষ পর্যন্ত রাস্তায় নামতেই বাধ্য হয়। একটি রক্তক্ষয়ী গণ-আন্দোলনের পর এখন আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হলো এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে একটি রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও শান্তিপূর্ণ প্রজন্ম গড়ে উঠতে পারে। সে লক্ষ্য পূরণে সরকার, নাগরিক সমাজ এবং সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনার প্ল্যাটফর্ম এবং গণপরিসর তৈরি করতে হবে, যা তরুণদের ক্ষমতায়ন এবং তাঁদের মতামত প্রকাশের গঠনমূলক জায়গা প্রদান করবে। তাহলেই নিশ্চিত করা যাবে যে দেশের উপেক্ষিত যুবসমাজের কণ্ঠস্বরও নীতিনির্ধারণের টেবিলে পৌঁছাবে এবং আগামী প্রজন্ম ইতিবাচকভাবে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
Apon Zahir is a Senior Research Associate at the Centre for Governance Studies. This blog was published as a part of the ongoing collaborative partnership project between the Embassy of the Kingdom of the Netherlands and the CGS under the project “Women and Youth Engagement in Politics in a Post-Uprising Bangladesh.”