সরকারের সমালোচনা করলে মামলা দেয়া আইনের অপব্যবহার

20 August 2023

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা, উন্নত গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা বলেছেন, আইন জনগণের জন্য তৈরি করা দরকার, সরকারের সমালোচনা করলে মামলা দেয়া আইনের অপব্যবহার। আইনের উচিত নিরপরাধকে নিরাপদ বোধ করানো কিন্তু এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মানুষের মধ্যে চাপ ও ভয়ের সৃষ্টি করেছে। বক্তারা আরো বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলাগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন। নাগরিক অধিকারের বিপক্ষের এ আইনকে বাতিল করার আহ্বান জানান তারা।

গতকাল অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে মুখ্য আলোচক ছিলেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট কামাল আহমেদ। আলোচনা করেন, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিসটিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ, আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল, নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও গবেষক আসিফ বিন আলী এবং গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রোজীনা বেগম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

ওয়েবিনারের শুরুতে জিল্লুর রহমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়াবহতা তুলে ধরে বলেন, নতুন সাইবার সিকিউরিটি আইনে অজামিনযোগ্য ধারা পরিবর্তিত করে জামিনযোগ্য ধারা করা হলেও নাগরিকদের এ সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। অতীতে লেখক মুশতাক বহুবার জামিনের আবেদন করলেও, তাকে আটক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলাগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন। নাগরিক অধিকারের বিপক্ষের এ আইনকে বাতিল করার আহ্বান জানান তিনি।

ওয়েবিনারে কামাল আহমেদ ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা, উন্নত গণতন্ত্র ও আমরা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ ও উন্নত বিশ্বে বিদ্যমান ডিজিটাল আইনের বিস্তারিত তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে ব্রিটেনে সরকারি খেতাবপ্রাপ্তদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের দায়ে পাঁচ লাখ পাউন্ড জরিমানার এবং টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার উদাহরণ টেনে বাংলাদেশে জবাবদিহিতার অভাবের কথা তিনি বলেন। ইইউ বা ব্রিটেনের আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ব্যত্যয় ঘটার মতো কোনো বিষয় না থাকার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। কামাল আহমেদ বলেন, সংক্ষিপ্ত নামকরণ ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে ইউরোপ বা যুক্তরাজ্যের আইনের সাথে আমাদের আইনের আর কোনো সামঞ্জস্যতা নেই, নাগরিকদের অগ্রাধিকারে তো নয়ই। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনের প্রয়োগ ব্যক্তির জন্য বা পেশার জন্য নয়, সবার জন্য হওয়া উচিত।

ড. আলী রীয়াজ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছুই পরিবর্তন না করে নতুন আইন করা হয়েছে। এজেন্সির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তো মতপ্রকাশ হতে পারে না, তা ছাড়াও বহু সমালোচিত অফিস সিক্রেসি অ্যাক্ট এই নতুন আইনেও আছে। সাইবার সিকিউরিটি আইনে কিছু ধারা সম্পূর্ণ হুবহু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেরই ধারা। তিনি আরো বলেন, যুক্তরাজ্যে একটি আইন প্রণয়নের আগে ২০১৮ সাল থেকে নিয়ে প্রথমে গবেষণা হয়েছে, স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা হয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে সাইবার সিকিউরিটি আইন নিয়ে নাগরিকের মতামত দেয়ার সময় মাত্র ১৪ দিন। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা হয়েছে বলে, তাড়াহুড়া করে সাইবার সিকিউরিটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা তাই প্রশ্নবিদ্ধ।

নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির বলেন, সাইবার স্পেস নিরাপদ রাখার জন্য আইনের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ বাংকের হ্যাক হয়ে যাওয়া টাকা, পাঁচ কোটি গ্রাহকের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়া, ওয়েবসাইটগুলো হ্যাকিং করার হুমকি পাওয়ায় বেশ কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করা এসব ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সঠিক বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তিনি আরো বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে খুব সুন্দর করে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কিছু করা যাবে না, বলা যাবে না, যা সঠিক ইতিহাস চর্চা করতে বাধা প্রদানের একটি উপায় মাত্র। অগণতান্ত্রিক আইন থেকে মুক্তি পেতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর এটি নিয়ে কথা হলেও সংশোধন আদৌ করা হয়নি। বিশ্ব সূচক অনুযায়ী, ডেনমার্কের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সবচেয়ে প্রশংসিত এবং যেসব দেশের আইন সমালোচিত তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। সমালোচিত আইন বাতিল না করে, তার অপব্যবহারের হিসেব না দিয়ে সংশোধন করে নতুন নাম নিয়ে আইন প্রণয়ন অযৌক্তিক। লোকজনকে আটক করে রাখা হয়েছে ভীতি তৈরি করতে, সেল্ফ সেন্সরশিপ তৈরি করতে আইন প্রণয়নের আগে আরো বেশি আলোচনা প্রয়োজন বলে তিনি তার বক্তব্যে যোগ করেন।

শিক্ষক ও গবেষক আসিফ বিন আলী বলেন, নারী শিশুদের সাইবার বুলি বা হয়রানি থেকে বাঁচাতে, হ্যাকিং থেকে বাঁচার জন্য, সাইবার জগতের নিরাপত্তার জন্য যথাযোগ্য আইনের প্রয়োজন রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এসব বিষয়ের সাথে সরকারের সমালোচনার বিষয় যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আইন জনগণের জন্য তৈরি করা দরকার, সরকারের সমালোচনা করলে মামলা দেয়া আইনের অপব্যবহার। আইনের উচিত নিরপরাধকে নিরাপদ বোধ করানো কিন্তু এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মানুষের মধ্যে চাপ ও ভয়ের সৃষ্টি করেছে।

গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী রোজিনা বেগম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার সিকিউরিটি আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নিয়ে বলেন, প্রতিষ্ঠান তো নির্ধারণ করতে পারে না কোনটি থাকবে আর কোনটি না। কোর্টের কোনো নির্দেশ ছাড়াই যেকোনো সময় আইনি পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি সংবিধানপরিপন্থী এবং কোনো একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই তা প্রতিহত করার চেষ্টাও আইনপরিপন্থী পদক্ষেপ। সাইবার সিকিউরিটি আইনের ক্ষেত্রে, ১৪ দিন মাত্র মতামতের জন্য দেয়া হয়েছে সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের জন্য যা যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করেন।

News Courtesy:

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/771150/%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%AA%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0

Comments