৫০ বছরে জার্মানি-বাংলাদেশ সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে
29 March 2022বাংলাদেশ-জার্মানি কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মোকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার। সোমবার (২৮ মার্চ) রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত 'জার্মানি-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন'- শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলার পাশাপাশি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনেও জার্মানিকে পাশে দাঁড়াতে হবে।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, এমপি।
অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন ফ্রেডরিখ-অ্যাবার্ট-স্টিফটাং বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি ফেলিক্স কোলবিৎজ এবং সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। মূল বক্তব্য রাখেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন।
উদ্বোধনী বক্তৃতায় ফেলিক্স কোলবিৎজ বলেন, ৫০ বছরে জার্মানি এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের উচিৎ ভবিষ্যৎ সম্পর্কের পথরেখার প্রতি নজর দেওয়া।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন সমস্যা একত্রে মোকাবিলার জন্য জার্মানি এবং বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী বন্ধুত্ব প্রয়োজন।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, পূর্ব জার্মানি, যেটি কিনা বর্তমানে জার্মানিরই অংশ, সেটি ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত জার্মানির সঙ্গে বাংলাদেশের একটি প্রাণবন্ত এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, জার্মানি এবং বাংলাদেশের মধ্যকার এই সম্পর্ক দুই দেশের নাগরিকদের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ৭০ এবং ৮০- এর দশকে এই সম্পর্ক ছিল কেবলই দাতা এবং গ্রহীতার, যেখানে জার্মানি এবং ইইউ থেকে বাংলাদেশ সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চলত। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর এই সম্পর্কের মাত্রা বদলে গেছে।
তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের পর এই সম্পর্ক বাণিজ্যিক রূপ লাভ করে। রপ্তানির দিক দিয়ে জার্মানি বর্তমানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘লক্ষ্যদেশে’ পরিণত হয়েছে। তিনি মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, অভিবাসন ইত্যাদি উল্লেখ করে বলেন, এসব বিষয় ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে জার্মানি এবং ইইউ’র কৌশলগত সম্পর্ক ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখবে।
একই সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে জার্মানি এবং ইইউ’র সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। বিশেষত, ভারত এবং চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সম্পর্ক এতে বড় ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, চীন বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক শক্তি। আবার, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে যে সুসম্পর্ক রয়েছে, তার ফলে ভারত-চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। বাংলাদেশকে ভারত এবং চীন উভয়ের সঙ্গেই তাই সতর্কভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হয়।
এছাড়া তিনি মানবসম্পদ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠলেও এর ভিত্তি এখনও মজবুত নয়। বৈদেশিক আয়, পোশাকশিল্প খাত এবং কৃষি খাতেই বাংলাদেশ বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সক্ষমতা অর্জন করেছে। তবে দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত হচ্ছে না। বাংলাদেশকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেকটি রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব কখনই চিরস্থায়ী হতে পারে না এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশ বা ইউক্রেনের মতো ছোট দেশগুলো অবশ্যই বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে নিজেদের রক্ষা করার সক্ষমতা রাখে।
আগামীতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনে তিনি জার্মানিকে সহায়তা দেওয়ার আবেদন জানান। বলেন, ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ সক্ষমতা অর্জন করেছে। তাই ইইউ’র জন্য বাংলাদেশ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের একটি বড় উৎস হয়ে উঠতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে পারে জার্মানি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সামরিক যন্ত্রাংশ ক্রয়ের ক্ষেত্রে সবসময় চীনের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে চীন আবার মিয়ানমারের পক্ষ হয়ে কাজ করে আসছে। ফলে এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এজন্য চীনের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে জার্মানি।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার বলেন, বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ এবং জার্মানি উভয় রাষ্ট্রেরই ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ শিগগিরই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। আসন্ন দিনগুলোতে বাংলাদেশ কীভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জার্মানি এবং বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক সবসময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোতে জার্মানি সবসময় বাংলাদেশের পাশে থেকে কাজ করে যাবে।
সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, বাংলাদেশ এবং জার্মানির মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক আমাদের কাছে সবসময়ই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে।
অনুষ্ঠানে মূল আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউ’র রাষ্ট্রদূত চার্লস হুইটলি, সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের উপদেষ্টা নাসিম ফেরদৌস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (পশ্চিম ইউরোপ ও ইইউ) ফাইয়াজ মুরশিদ কাজী, বাংলাদেশ-জার্মান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল মুক্তাদির এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও গবেষক রুবাইয়াত হোসেন।
News Courtesy: